গল্প- রুপোর সিন্দুক

রুপোর সিন্দুক
-সুমিতা দাশগুপ্ত

দীর্ঘদিন পর, বাচ্চাদের স্কুলগুলো আবার ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছে। সুপর্ণার নাতনি, ক্লাস থ্রি-র পড়ুয়া রাই আজ অনেক দিন পর আবার স্কুলে গেল। ধোপদুরস্ত ইউনিফর্ম গায়ে, পিঠে দামী স্কুলব্যাগ ঝুলিয়ে, দোতলায় দাঁড়ানো সুপর্ণার দিকে চেয়ে একগাল হেসে হাত নেড়ে পুলকারে গিয়ে উঠলো। গাড়ির ভিতর থেকে আর‌ও কয়েকটি শিশুর কলকাকলি ভেসে আসছিলো, কী খুশি যে দেখাচ্ছিল ওদের! স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরে যেন ফুরফুরে এক একটা প্রজাপতি ওরা।
গাড়িটা চলে যাবার পরও আকাশে বাতাসে একটা আনন্দের রেশ বয়ে যাচ্ছিলো। তাঁর নিজের মনটাও বেশ ভালো লাগছে আজ -যেন মুক্তির হাওয়া তাঁকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে।
আর‌ও খানিকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে সকালটা উপভোগ করছিলেন তিনি।
‌ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদটা চড়চড়িয়ে উঠতে থাকে। এবারে তাই ধীরে ধীরে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন সুপর্ণা।
ঘরের ছড়ানো ছিটানো কিছু অগোছালো জিনিসপত্র, জায়গায় রেখে জানলার পাশে রকিং চেয়ারটায় গিয়ে বসলেন তিনি। সংসারের আসল দায়িত্বভার বৌমাই সামলায়। সুপর্ণাও অবশ্য অনেক ধরনের টুকিটাকি কাজে কর্মে ব্যস্ত রাখেন নিজেকে।পুরো বাড়িটার আসবাবপত্রের ধুলো ঝাড়া, সোফার উপরের কুশনগুলো গুছিয়ে রাখা, ফুলদানিতে বাগানের ফুল পাতা তুলে এনে সাজানো ইত্যাদি ইত্যাদি।আজ অনেক দিন পর নাতনির সঙ্গে কিছুটা দৌড়াদৌড়ি করে , সামান্য ক্লান্ত লাগছে। তাই বারান্দায় রাখা আরাম কেদারায় গিয়ে বসলেন,একটু বিশ্রাম নিয়েই আবার কাজে নামবেন না হয়! অন্যমনস্ক হয়ে, পাশের টেবিলে রাখা মোবাইলটা হাতে নিলেন , অন্ করতেই ফেসবুকের মেসেজ দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। সম্প্রতি ,বৌমার আগ্রহে ফেসবুকের জগতে প্রবেশ করার পর থেকে,দীর্ঘকাল আগে হারিয়ে যাওয়া কিছু পরিচিত মানুষকে খুঁজে পেয়েছেন। বেশ লাগে তাদের সঙ্গে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে।
সেই রকম‌ই একজন হলো বিনি। বিনি তার স্কুলের সহপাঠিনী ছিল। তারপর জীবনের স্রোতে কে যে কোথায় ভেসে গিয়েছিল! বিনি আপাতত সপরিবারে পুরী বেড়াতে গিয়েছে , আর ক্রমাগত প্রচুর ছবি পোস্ট করছে। ছবিগুলো দেখতে দেখতে মুখে একটা মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো সুপর্ণার। চিরকালের উচ্ছ্বল স্বভাবের মেয়ে বিনি আজও ঠিক একই রকম রয়ে‌ গেল।
বিনির কথা ভাবতে গিয়ে, কখন যেন অতীতের পথে স্মৃতির সরণী বেয়ে হাঁটা শুরু করেছেন সুপর্ণা ! বিনি তাঁর ছেলেবেলার বান্ধবী, পাশাপাশি বাড়িতে থাকার সুবাদে এক‌ই সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা। তাদের দুই পরিবারেও বেশ হৃদ্যতা ছিল। এক‌ই সঙ্গে স্কুলে ভর্তি হবার পর কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে স্কুল যেতেন তাঁরা । না তাঁর নাতনির মতো এতো সফিস্টিকেটেড ব্যাপার স্যাপার ছিল না তখন, খুব সাধারণ মোটা কাপড়ের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ ,যা তখনকার দিনে বাজারে মিলতো । তাই দিয়েই দিব্যি চলে যেত তাঁদের।
এরপর একবার একদিন বেশ একটা মজার ঘটনা ঘটলো। সেবার নতুন বছরে অন্য একটা শহর থেকে একটি নতুন মেয়ে এসে ভর্তি হলো।
একে বড়লোকের মেয়ে , তায় চালবাজ , প্রথম থেকেই মেয়েটিকে একটু এড়িয়ে থাকতেন ‌তাঁরা, বিশেষ ভাব ভালবাসা হয়নি ।তাতে কী ! মেয়েটিকে ঘিরে কৌতূহলের কমতি ছিল না তাঁদের । অনেক কারণের মধ্যে একটা, ছিল মেয়েটি ব‌ই নিয়ে আসতো একটা চকচকে রুপোলি বাক্স করে,হাতে ঝুলিয়ে, তাঁদের মতো কাঁধে ঝুলিয়ে নয় । এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য , তাদের কল্পনারও বাইরে, ব‌ই যে ব্যাগের বদলে বাক্স করে আনা যায় ,সেই তাঁদের প্রথম দেখা। বেঞ্চের উপর বাক্সটা রেখে ঢাকনাটা সামান্য ফাঁক করে ব‌ই খাতা বের করেই তড়িঘড়ি বন্ধ করে দিতো ,যেন ওটি মহামূল্যবান ধনসম্পদে ঠাসা ,কেউ দেখে ফেললেই সর্বনাশ, তাছাড়াও , হাওয়ায় গল্প ভাসতে লাগলো ওটি নাকি, তার ঠাকুমার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া রুপোর বাক্স , যক্ষের পাহারায় থাকে, ওতে অন্য লোকের হাত পড়লেই ,না হাত পড়লে যে কী হবে সেকথা ,আর মুখ ফুটে বলে নি সে। তাঁদের ঐটুকু বয়সের নিস্তরঙ্গ জীবনে ,সে কী সাঙ্ঘাতিক রোমাঞ্চকর ব্যাপার!
আড়ে আড়ে সবসময , বাক্সটার দিকে চেয়ে থাকতেন তাঁরা।
কয়েকদিনের মধ্যেই অবশ্য তার ধাপ্পাবাজি ধরা পড়ে গিয়েছিল, তাদের মফস্বল শহরের দোকানগুলোতে এ্যালমুনিয়ামের বাক্সের চালান আসতে দেরী হয় নি।
স্বাভাবিকভাবেই লোকজন ঐ আকর্ষণীয় বাক্স কিনতে এবং নানা কাজে ব্যবহার করতে শুরু করলো।
তাঁরা নিজেরাও অনতিবিলম্বে অভিভাবকদের, বায়নায় জেরবার করে ঐ বাক্স আদায় করেই ছেড়েছিলেন। সবচেয়ে মজার কথা , এরপর ঐ নবাগতা মেয়েটির সঙ্গে ভাব হতেও দেরী হয় নি। আসলে শিশু বয়সের ধর্ম‌ই তাই ! ঝগড়াঝাঁটি , মনকষাকষি এই সবকিছুই তো প্রাপ্তবয়স্ক লোকদের ব্যাপার!
জ্যাঠামশাই, দোকান থেকে তাঁদের দুজনের বাক্সের উপরে চমৎকার ডিজাইন আঁকিয়ে, নাম লিখিয়ে এনেছিলেন। ছোট্ট ছোট্ট দুখানা তালাও জুটেছিল সেই বাক্সদুটির।
কী সুন্দর ছোট্ট লকেটের মতো দুলতো বাক্সের গায়ে!
এর ফলে তাঁদের নিজেদের অজান্তেই আর‌ও একটা ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল । ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে একটা নিজস্ব সম্পত্তির বোধ‌ও জাগ্রত হতে থাকলো , ব্যাগ, ব্যাপারটা এজমালি আর বাক্সটা একান্ত‌ই নিজের।
নিষিদ্ধ প্রেমের আভাস‌ও প্রথম জানা হয়েছিল এই সূত্র ধরেই ।উঁচু ক্লাসের এক দিদির আধখোলা বাক্সের মধ্যে থেকে ভেসে আসা গোপন প্রেমপত্রের গায়ে মাখানো সেন্টের গন্ধে।
‌ধাপে ধাপে উঁচু ক্লাশে ওঠার পর্যায়ে সেই বাক্স আর ব‌ইয়ের বাক্স র‌ইলো না ,সেটি রূপান্তরিত হয়ে গেল ব্যক্তিগত টুকরো স্মৃতির ঝাঁপিতে। পুরনো গ্রিটিংস কার্ড , স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার আগে ক্লাশের ছাত্রীদের সঙ্গে তোলা, হলদে হয়ে যাওয়া গ্রুপ ফটো , বন্ধুদের বিয়ের কার্ড, প্যাঁচ হারানো কানের দুল– আরও কতো কী!
বিয়ের পর বাক্সটি তো আর সঙ্গে আনা হয় নি, বাপের বাড়িতেই রয়ে গিয়েছিল, ক্রমে ভুলেই গিয়ছিলেন সেটির কথা। তারপর বহুবছর পরে,এই বছর তিনেক আগে, একদিন তাদের পুরনো বাড়ি সারাই করতে গিয়ে বিস্তর বাতিল জিনিসপত্রের মধ্যে থেকে উদ্ধার হওয়া বাক্সটা বড়দা এনে তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন ।কী যে খুশি হয়েছিলেন সুপর্ণা –যেন পুরো ছেলেবেলাটা এসে ধরা দিয়েছিল , তাঁর হাতের মুঠোয়।
আজ তাঁর অনেক আলমারি , কাবার্ড,বাকসো ,ডেসকো — তবু তার মাঝে, এটি এক অমূল্যধন । এটিতে হাত বুলিয়ে তিনি যেন পূর্বাচলের পানে ফিরে তাকান, তাঁর এই অপরাহ্ণ বেলায় !
আচ্ছা বিনির কাছে ওর বাক্সটা আজও আছে? খোঁজ নেওয়া হয়নি তো!
হঠাৎ সম্বিত ফিরলো।
মনে হলো অনেক দিন খোলা হয়নি বাক্সটা। দুপুরের নিভৃত অবসরে আজ আরও একবার বাক্সটা নিয়ে বসলে বেশ হয় কিন্তু!

Loading

Leave A Comment